বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী কুকড়াইল ও রামপুর বাসীর দুঃসময়ে পাশে দাড়িয়েছিলেন ১৯৭৪ সালে

চোখের  পানি ধরে রাখতে পারিনি আমার দুটি গ্রামের করুন  এই কাহিনি পড়ে পড়ুন মুজিব সরকারের আমলে লেখা আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখা-

প্রকাশিতব্য স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বই থেকেঃ 

"১৯৭৪ সালে টাঙ্গাইল শহর থেকে মাত্র পনর মাইল দূরে কালিহাতী থানার রামপুর ও কুকরাইল গ্রাম দুট পুলিশ মাটিতে মিশিয়ে দেয়। গ্রামবাসীর মতে ডাকাত ও দুস্কৃতিকারীদের গ্রামবাসীরা ধাওয়া ও পিটুনি দিলে একজন নিহত হয়। সেই নিহত ব্যক্তির একজন পুলিশ সদস্য ছিলো। পুলিশ হত্যার প্রতিশোধ নিতেই এই গ্রামগুলোতে হামলা চালিয়ে, ঘরবাড়ি ভষ্মিভুত করা, লুটপাট ও নারী পুরুষ বৃদ্ধ নির্বিশেষে গ্রামবাসীকে অবর্ণর্নীয় মারধর করে পুলিশ। টাঙ্গাইলের এই কাহিনী সরকারী কাগজে গুরুত্বসহ ছাপা হয়নি, বেতারে-টেলিভিশনে চাপা দেয়া হয়েছে। 
  
ঘটনার এক সপ্তাহ পরে আবদুল গাফফফার চৌধুরী এই দুই গ্রামে যান। ফিরে এসে তিনি দৈনিক জনপদে একটা উপসম্পাদকীয়তে লেখেনঃ 
  
 
“আমরা প্রথমে ঢুকলাম কুকরাইল গ্রামে। এক নজর দেখেই মনে হলো, একটা বন্য হাতি যেন সারা গ্রামটাকে লন্ডভন্ড করে রেখে গেছে। আর বন্য হাতির সেই তান্ডব থেকে কেউ রক্ষা পায়নি। এমনকি দুগ্ধপোষ্য শিশু, নারী এবং অবুঝ জীবজন্তুও নয়। একটার পর একটা আগুনে পোড়া বাড়ি। টিনগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। চাল, ডাল, কলাই, তিসি, তাঁতের সুতা, সুতার রং ভস্মীভূত। যে বাড়িগুলো আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছে, তা নির্মমভাবে লুন্ঠিত। মেয়েদের শরীর থেকে পর্যন্ত সোনা আর রূপার গয়না ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। গরু পুড়েছে, হাঁস-মুরগি-ছাগল পুড়ে ছাই হয়েছে - তার কংকাল চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। যারা সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে, তাদের সম্বিত এখনাে ফেরেনি। আমাদের দেখে একদল সর্বহারা নর-নারী সমস্বরে কেঁদে উঠলো। লজ্জা ভুলে মায়ের বয়েসী কয়েকজন মহিলা এসে আমার পা জড়িয়ে ধরলো। তাদের কারো কারো দেহে নির্মম প্রহারের চিহ্ন। তাদের কান্নায় আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে। জানিনা মানুষের গদি কেঁপে ওঠে কিনা।
 
কার কথা লিখবাে ? শয়ে শয়ে পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে। অসংখ্য বাড়ীঘর, দোকান, তাঁত ভস্মীভূত হয়েছে। এমন হয়েছে--বহু পরিবারের আজ মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। এক মুঠো খাবার সংগ্রহের সংস্থান নেই। মানুষের মধ্যে পশু প্রবৃত্তি এতটা মাথাচাড়া দিতে পারে, তা আমার জানা ছিল না। অত্যাচারীরা গ্রামবাসীদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে তাদের সর্বস্ব লুট করে সন্তুষ্ট হয়নি, গ্রাম দু’টোর প্রত্যেকটি ইদারায়, প্রত্যেকটি পুকুরে পেট্রোল আর কেরােসিন ছিটিয়ে পানীয় জল পানের অনুপযুক্ত করে রেখে এসেছে। একটি চৌদ্দ বছরের ছেলে - সারা গায়ে মারের দাগ, এক বদনা পানি ইদারা থেকে তুলে এনে আমাকে দিল। বললাে: ‘একটু মুখে দিয়ে দেখুন।’ মুখে দিতে হল না, নাকের কাছে নিতেই দেখি, কেরোসিনের উৎকট গন্ধ। দগ্ধ, লুণ্ঠিত, বিধ্বস্ত গ্রামটিতে কান্নায় ভেংগে পড়া নারীপুরুষের পাশ কাটিয়ে হাঁটছিলাম আর ভাবছিলাম তিন বছর আগের কথা।
 
আমি কাঁদতে ভুলে গেছি। কিন্তু কুকরাইলের সাত সন্তানের মা আছিয়া খাতুন, বৃদ্ধা করিমুন্নেসা আর আবদুল হালিমের মেয়ে সাহেরা খাতুনকে দেখে আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিলো। অত্যাচারীরা একেবারে পশু না হলে মেয়ে মানুষের গায়ে এমনভাবে হাত তুলতে পারে না। করিমুন্নেসার মাথা ফাটানো। সাহেরা খাতুন যুবতী। তার সর্বাঙ্গে রোলারের প্রহার এবং নখরাঘাতের চিহ্ন। আছিয়া খাতুনের পিঠ ফুলে ঢোল হয়ে আছে। মনোয়ারা নামে এক মেয়ের অবস্থা দেখে আমি রাগে ক্ষোভে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
 
কুকরাইল গ্রামে এমন একজন সম্পন্ন মানুষ নেই, যার বাড়ি লুট হয়নি। ডাক্তার মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিনের বাড়িতে ঢুকে তার সব দূর্মূল্য ডাক্তারি যন্ত্রপাতি পর্যন্ত নষ্ট করা হয়েছে। ঘরের খাট-পালঙ্ক, লেপ-তােষকে আগুন দেয়া হয়েছে। ব্লাড প্রেসার মাপার একটা আনকোরা নতুন যন্ত্র দেখি ভেঙ্গে বারান্দায় ফেলে রাখা হয়েছে। পাশের বাড়ি থেকে লুট করা হয়েছে রেডিও। পুরনো আমলের একটা গ্রামােফোন যন্ত্র আছড়ে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। দু'হাতে লুটপাট করা হয়েছে রামপুর ও কুকরাইল গ্রাম। লুটেরারা গরুর গাড়ী বােঝাই করে লাখ লাখ টাকার লুটের মাল নিয়ে গেছে। যা নিতে পারেনি, তা পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে গেছে। রামপুরের ইদ্রিস মিয়া যথেষ্ট মান্যগণ্য লােক। তার বাড়িতে টিনের ঘর চৌদ্দটি। তাঁত ৩৫টি। গােলায় ৩৫ মণ ধান। ঢেকিতে ছেঁটে তােলা হয়েছে ১৫ মণ চাল। তাছাড়া আছে সরিষা, কলাই। ঘরে ছিল তাঁতের কাপড়ের কয়েকশো পাউণ্ড রং। যার প্রতি পাউণ্ডের দাম দেড় হাজার টাকা। ইদ্রিস আলী কিছু লেখাপড়া জানেন। তাই সখ করে তার তাঁত শিল্পের নাম করেছেন ‘দেশবন্ধু হ্যাণ্ডলুম’। এই হ্যালুমের ৩৫টি তাঁতই এখন বিধ্বস্ত।দু’একটা যা বেচেছে তার সূতা ছিড়ে দেয়া হয়েছে। ১৪টি বড় টিনের ঘরই ভস্মীভূত। ৩৫ মণ ধান, ১৫ মণ চাল, সরিষা-কলাই, কয়েক শ' পাউণ্ড রং সব শেষ। রামপুরের আজিজুর রহমানের অবস্থা আরাে শােচনীয়। ৩২ বছরের যুবক। গ্রামের সবচেয়ে বড় তাঁতী। ৮০ হাজার টাকার তৈরী তাঁতের কাপড় ও সূতা ছিল তার ঘরে। সব লুষ্ঠিত। তার ও তার ভাইয়ের যুবতী বৌয়ের পরনের কাপড় ছাড়া ঘরে আর কিছু নেই যা লুষ্ঠিত হয়নি।
 
আজিজুর রহমানের বিধ্বস্ত ঘর থেকে যখন বেরুচ্ছি, তখন শুনি মেয়েকণ্ঠে উচচ স্বরে রােদন। উঠানে না নামতেই পায়ের ওপর আছাড় খেয়ে পড়লেন একটি মেয়ে। নাম সখীনা। অল্প বয়সে বিধবা হয়েছেন। একটি তাঁত চালিয়ে কোনরকমে দিন কাটান। সেই তাঁতটি ধ্বংস করা হয়েছে। সখীনার এখন জিজ্ঞাসা তিনি কিভাবে দিন গুজরান করবেন?
এই প্রশ্নের জবাৰ কে দেবে?

কুকরাইল থেকে রামপুর গ্রামে গিয়ে উঠলাম। সেই একই ইতিহাস, একই ধ্বংসের স্বাক্ষর। যে গৃহস্থের ছ’টি গরু গােয়ালে জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে, তার বুকে পুত্রশোকের মত ব্যথা। আমাদের দেখে সে হাহাকার করে উঠল। বাইরে উন্মুক্ত আকাশের নীচে ছ’টি গরুর দগ্ধ কঙ্কাল।

হাঁটতে হাঁটতে একটা ব্যাপার বিস্ময়কর মনে হচ্ছিল। বাংলাদেশের গ্রাম। কিন্তু কোন বাড়িতে হাঁস-মুরগীর সাড়া-শব্দ নেই। বৃদ্ধ করিম মিয়াকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, কিছু পুড়ে মরেছে। কিছু লুটেরারা নিয়ে গেছে। দু’শ থেকে আড়াই শ ছাগল ওরা লুট করেছে।
 
কী লুট করেনি ওরা ? রামপুর হাটের বৃদ্ধ হাজী আব্দুস সবুর মিয়া। এবছরই হজ্জ করে দেশে ফিরেছেন। হাটে তার কাপড়ের দোকান। বেশী রাখেন কাফনের কাপড়। ত্রিশ হাজার টাকার কাপড় ছিল তার দোকানে। সব লুট। দোকনাটাও ভেঙে দেয়া হয়েছে। নিজের দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে হাজী সাহেব শিশুর মত অঝাের কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আমি জানি, এই কান্না বৃথা যাবে না। বাংলার দুঃখী মানুষের এই কান্না থেকে আবার একদিন বাষ্প হবে, মেঘ হবে। ঝড়ের অশনি সংকেতও দেখা দিতে পারে আজকের শান্ত নীলাকাশে।

পুলিশের দু’দুটো গ্রাম ধ্বংস করা এবং নিজেদের হাতে আইন তুলে নেয়া অমার্জনীয় অপরাধ। এটা একটা জঘন্য নজীর। এর প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত অশুভ ও সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। ”

লোক মুখে কথিত আছে,  বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এর সহোযোগিতায় এমন নৃশংস তান্ডব থেকে রক্ষা পায় কুকড়াইল ও রামপুর বাসী। তিনিই সেই হিংস্র পুলিশবাহিনীর নৃশংসতার মোকাবেলা করে। রামপুর বাসী তা কখনও ভুলবে না। 

বিঃদ্রঃ লেখা সংগ্রহ করেছে- মুন্না সিকদার, রামপুর বাজার, কালিহাতী, টাংগাইল 

Comments